Sunday, May 6, 2012

জনম জনম ধরে

[প্রথম প্রকাশঃ দৈনিক ইত্তেফাক ঃ ঢাকা ঃ মঙ্গলবার, ৮ই শ্রাবন, ১৩৯৭]

গত পরশুদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিলো। একেবারে রাস্তাঘাটে পানি আর পানি। হাঁটু পানি জমে ছিলো বাজারের ভেতর, বাইরে বেরুবার পথে রেললাইনের নীচে সবখানে । পিচ্চি কুলিগুলো লুঙ্গির কোন বগলে নিয়ে মাথায় ঝুরিভর্তি তরিতরকারি,  চাল, ডাল বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল পানি ভেঙ্গে।  আজ আর তেমন বৃষ্টি হয়নি । রেললাইনের নীচে ময়লাভরা ড্রেনগুলোতে লম্বা নখের মত কয়েকটা  পোকা একখানে জমে বজবজ করছে। যেখানে সেখানে অন্য দিনের চেয়ে বেশী পানি জমে আছে।  মাটিও ভিজে ভিজে। দেখলে মনে হয় গতকাল বৃষ্টি হয়েছিলো। তবে বৃষ্টি না হলেও মেঘলা ছিলো সারাটা দিন। গুমোট ভাব। রোদের মুখ দেখা যায়নি। আজ এখন এই বেলা দুইটা অবধি রোদের মুখ দেখা না গেলেও আকাশটা পরিচ্ছন্ন। গতকালের মতো মেঘলা নয়। মনে হচ্ছে আজ বিকেলে সেস রোদের ঝলক দেখা গেলেও যেতে পারে। নরম মাটিতে পিঁপড়েরা ঢিবি বানিয়েছে উঁচু উঁচু । কামরাঙ্গা গাছের ভেঙ্গে যাওয়া একটা ডাল গাছটার সাথে এখনও একটুখানি লেগে আছে । দোল খায় বাতাসে। মনে হয় এক্ষুনি নীচে পড়বে। অথচ পড়েনা। নিমগাছে ময়নারা এসে হুল্লোড় করে। নরম মাটি থেকে কেঁচো টেনে টেনে খেয়েছে তাই।  নিমগাছের নীচে বাধা ছাগল ভ্যা ভ্যা করে ডাকে। মাথায় নিমফল পড়ে টুপটাপ। চুপ করে কিছুক্ষন। কান ঝটপট করে। মুখ ঘুড়িয়ে ল্যাজের নীচেটা চুলকে নেয়, হাটুগুলো ভাল করে চেটে চেটে পরিস্কার করে নেয় তারপর আবার ভ্যা ভ্যা ডাক ছাড়ে। অপরিচিত জাগাতে এলে ছাগলরা স্বজন হারাবার ব্যাথা প্রকাশ করে এভাবেই ঘন ঘন ডাক ছেড়ে। যদি ডাকে সাড়া দেয় কেউ তাহলে বুঝবে যে পরিচিত ছাগলের বা পরিবেশের কাছাকাছি আছে।

আজ প্রায় দেড় বছর পরে শওকতের সাথে কথা হলো আলেয়ার । যোজন যোজন দূর থেকে কথা বলছিলো শওকত অথচ মনে হচ্ছিল পাশে বসে কথা বলছে। কিন্তু শওকতকে মনে হচ্ছিল যেন অন্য মানুষ। কঠিন কোন পাথরের মূর্তির মুখ থেকে শব্দ বেরুচ্ছে একটা একটা করে। আলেয়ার ভাল মন্দ কিছুই জানতে চায়নি শওকত । শধু বললো - আলেয়া, তোমার জন্য আমার আর কিছুই করার নেই। তুমি নিজের পথ বেছে নাও।

এ কথা উত্তরে কি বলবে আলেয়া ভেবে পায়না। গত দেড় বছর ধরে সে শওকতকে খুজেছে।  আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই বলেছে তারা জানেনা শওকতের ঠিকানা। কেঁউ কিছু বলতে পারেনা।  তবু আলেয়া হার ছাড়েনি। শওকত তাঁকে একেবারেই ভুলে গেছে। অনেক দিন হয়ে গেছে কোন খোঁজ-খবর করেনি।  তবু আলেয়া খুজেছে শওকতকে। কোথাও না পেয়ে অকস্মাৎ একদিন ফিল্মী কায়দায় শওকতের খোঁজ পেয়ে গেলো সে । শহরে এসে আলেয়া যেখানে থাকে সেখানে তার আপন কেউ নেই। আছে এক পাতানো খালা। এই খালা তাঁদের গ্রামেরই মানুষ। খালু মারা গেছেন অনেকদিন হয়ে গেছে।  ছেলে-মেয়ে-বুউ-নাতি ভরা সংসারে অনেক মানুষের আসা যাওয়া। আলেয়া গ্রাম থেকে এসে এখানেই উঠে। থাকে-খায় কেউ কোন প্রশ্ন করেনা। এক গায়ের মেয়ে খালা আদোর করে আলো বলে ডাকেন। খালার ছেলে বউরা বাচ্চাদের আলেয়ার কাছে রেখে এখানে ওখানে বেড়াতে যায়। খালার অনেক বড় বাড়ী, অনেক মানুষ, অনেক ঘর। এখানে থাকতে থাকতে আলেয়া সংসারের একজন সদস্যের মত হয়ে গেছে।  খালার বাসার নীচের তলাটা অনেকদিন খালি ছিলো।  বন্যার সময় যখন পানি এসে নীচের তলাটা ভরে যায় তখন ভাড়াটেরা চলে যায়।  তারপর বেশ ক'দিন ঘরগুলো স্যাতস্যাতে ছিলো। প্রায় মাস ছ'য়েক খালি থাকার পর ভাড়াটে এলো। আলেয়া গেল তাদের সাথে আলাপ করতে। আলাপ করতে করতে এক সময় শওকতের প্রসঙ্গ এলো। বয়সী এক মহিলা তার দুই ছেলে নিয়ে থাকে । মহিলা আলেয়াকে দেখেই প্রথম প্রশ্ন করে - তোমার বিয়ে হয়নি? আলেয়া মিথ্যা বলতে পারেনা। বললো - হয়েছে।

- জামাই কি করে?
- কি করে তা তো ঠিক জানিনা।
- সেকি কথা! তোমার স্বামী কি করে তুমি জানোনা ?
- কেমন করে জানবো, কাছে যে থাকেনা ।
- তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে ?
- না, তাও দেয়নি।
- ছেড়েও দেয়নি আবার খোঁজ-খবর নেয় না এ আবার কেমন কথা !

ভদ্রমহিলা চোখ বড় করে। আলেয়ার হাতের উপরে সান্তনার হাত রাখে। বলে - বাড়ী কোথায় তোমার ?
-নড়াইল।
- আর জামাইয়ের বাড়ী?
- ফরিদপুর
- ফরিদপুর কোথায় ?
- রাজবাড়ি।
- কোন বাড়ির ছেলে?
- চৌধুরীর বাড়ির সেজ ছেলে শওকত। আপনি চেনেন খালাম্মা ?

- চিনি বৈকি। সে তো আমার ছেলেদের বন্ধু। এদের দাদূর বাড়ী তো ওখানেই ।

আলেয়া উত্তেজিত হয়ে উঠে। চোখের নীচের গভীর কালো রেখা শির শির করে । চোখ জ্বলা করে। ঠোঁট কাঁপতে থাকে। ভদ্র মহিলা আলেয়ার পিঠে হাত রাখেন। তারপর কিছুটা সময় চুপচাপ তিনি আলেয়ার উত্তেজিত চোখ, ঠোট প্রত্যক্ষ করেন। তারপর ধীরে ধীরে তিনি যা বলেন তার সারমর্ম হলো - শওকত প্রায় বছর খানেক আগেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে। বিদেশের কোন দেশে থাকে তা তার ছেলেরা বলতে পারবে। সেখানে সে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তার ঠিকানা টেলিফোন নম্বর সব কিছুই ছেলেদের কাছে আছে। ওরা ঘরে ফিরলে সে নিয়ে রাখবে আলেয়ার জন্য ।

নড়াইলের যে গ্রামে আলেয়া থাকতো সেখানে একটা নদী ছিলো । খুব শান্ত নদী। কোন স্রোত নেই। জোয়ার-ভাটা কিছু নেই। যেমন শৈশবে ছিলো তেমতি কৈশরে দেখেছে তাকে । যৌবনে এসে মনে হতো এটা নদী নয় নদীর ফসিল। ফসিল দেখলে যেমন বোঝা যায় এটা কার ফসিল, মানুষ না জানোয়ারের; আর যদি জানোয়ারের ফসিল হয় তাহলে বোঝে যায় কোন জানোয়ারের; বাঘ, ভাল্লুক, কুকুর নাকি প্রাগৈতিহাসিক কোন জীবের। তেমনি সেই নদীটা দেখলে বোঝা যায় বহুদিন আগে সে স্রোতস্বিনী ছিলো । এখন মৃত। ফসিল । সেই নদীর ফসিলের পাঁড় দিয়ে আলেয়া স্কুলে যেতো । নদীর পাড়, আখের ক্ষেত, সরষের ক্ষেত, ডাল নয়তো আলু বোনা মাঠের পাশে আলের ওপর দিয়ে স্কুলে যেতো তারা । তাঁদের স্কুলটা ছিলো বাঁশের তৈরি বেড়া দিয়ে ঘেরা আর চালটা ছিলো টিনের। সূর্য মাঝ আকাশে এসে বসলে স্কুলে টেকা যেতোনা গরমে। ঘামের সোঁদা গন্ধ শরীরে শুকিয়ে গেলে স্কুল ছুটি হতো । স্কুলে আলেয়ার একটা বন্ধু ছিলো সাকেরা।

সাকেরা খুব কালো ছিলো । সাদাটে ঠোঁট আর বড় বড় চোখ ছিলো সাকেরার। খুব ভাল মেয়ে ছিলো সে। মাঝে মাঝে নিজের রংরের জন্য দুঃখ করতো । আলেয়া সান্তনা দিয়ে বলতো - তোর বাপের অনেক টাকা আছে। দেখিস তোর বাপ তোর জন্য ঠিকই একটা ছেলে কিনে ফেলবে। কথাটা সাকেরাকে তেমন সান্তনা দেয়নি। শুনে সে গম্ভীর হয়ে ডাগর চোখে অন্যমনস্ক হয়েছিলো শুধু। ঘরে সৎ মা আছেন। তিনটা বোন আছে সেই মায়ের ঘরে। সৎ মা বাবাকে সাকেরার জন্য টাকা খরচ করতে দেবেননা। শওকত ছিলো সাকেরার লজিং মাস্টার।


[চলবে ]

No comments:

Post a Comment